চতুর্থ অধ্যায়ের বিষযবস্তু সংঘবদ্ধতার গোড়ার কথা । এখানে সংঘবদ্ধতা কথাটি ব্যবহারের তাৎপর্য হলো 1757 খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় ।1857 খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহে প্রথম ঐক্যবদ্ধভাবে বৃটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয় । এর আগে বৃটিশের বিরুদ্ধে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল কিন্তু সেগুলো নিতান্তই আঞ্চলিক বিদ্রোহ । স্থানীয় কোনো নেতার নেতৃত্বে এই বিদ্রোহগুলি সংঘটিত হয় সেখানে কোনরূপ জাতীয় চেতনার ছাপ ছিলনা । আঠারোশ সাতান্ন খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সিপাহী বিদ্রোহ , সভা-সমিতি , জাতীয়তাবাদী সাহিত্য প্রভৃতির মাধ্যমে ভারতীয়রা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল ।
সিপাহী বিদ্রোহের কারণগুলি ছিল রাজনৈতিক , সামাজিক, অর্থনৈতিক , ধর্মীয় ,সামরিক প্রভৃতি । রাজনৈতিক কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে লর্ড ডালহৌসি যে স্বত্ববিলোপ নীতি প্রয়োগ করেছিল তার ফলে বহু অপুত্রক রাজার উত্তরাধিকারীরা তাদের অধিকার হারিয়েছিল । সামাজিক কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে শাসক ও শাসিতের অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার ও ভারতবাসীর মধ্যে একটা বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি হয়েছিল যা ভারতবাসীর মনের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল আবার ব্রিটিশ সরকার যে কুসংস্কার ও কুপ্রথাগুলির অবসান ঘটিয়েছিল সেগুলিও বহু ভারতবাসী ভালো চোখে মেনে নেয়নি । সতীদাহ রদ , বিধবা বিবাহ প্রবর্তন , গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন প্রভৃতি সংস্কারগুলি ভারতবাসি ভালো চোখে নেয়নি । অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে ভারতবাসীর চূড়ান্ত দারিদ্রতা । ধর্মীয় অসন্তোষের কারণ ছিল খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারকরা ভারতবাসীর ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে আঘাত হেনেছিল এবং ছলেবলে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করতে থাকে এবং তাতে ব্রিটিশ সরকারের মদত ছিল । সিপাহী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ ছিল রটে যায় এনফিল্ড রাইফেলের যে কার্তুজ ছিল তার টোটা দাঁতে কেটে গুলি ভরতে হতো এবং সেটা গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা হয়েছে হিন্দু ও মুসলমান সৈনিকের ধর্মনাশ করার জন্য ।
ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা হয় এবং শীঘ্রই সারা উত্তর ভারতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে যায় । পরবর্তীকালে তা মহাবিদ্রোহের রূপ নেয় । বীর সাভারকর সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করেছেন । যদিও , এটা নিয়ে বিতর্ক আছে । অনেকের মতে এই বিদ্রোহ সারা ভারতবর্ষে হয়নি । তাছাড়া বিদ্রোহীদের মধ্যে কোন জাতীয় চেতনা ছিলনা । অনেকে এই বিদ্রোহকে সামন্ততান্ত্রিক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছেন কারণ বিদ্রোহীরা নিজ নিজ রাজ্য ফিরে পাওয়ার আশায় এই বিদ্রোহে যুক্ত হয়েছিল তবে এর বিপরীতে বলা যায় সিপাহীদের দ্বারা সূত্রপাত হওয়া এই বিদ্রোহে ভারতের সাধারণ নাগরিকেরা যোগ দিয়েছিল । একটি বিদ্রোহে সেই দেশের সকল নাগরিক যোগ দেয়না কিছু সংখ্যক মানুষ প্রত্যক্ষভাবে যোগ দেয় বাকিরা সমর্থন করে । বাহাদুর শাহকে তাদের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হিসেবে ঘোষণা করেছিল । তাছাড়া জাতীয়তাবাদ ধারণাটি তখনও পর্যন্ত কোথাও গড়ে ওঠেনি । তবে বাঙালি জাতি সেই সময় সিপাহী বিদ্রোহকে সমর্থন করেনি । হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো মুষ্টিমেয় মানুষ সিপাহী বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল । সম্ভবতঃ , বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় সেইসময় ইংরাজি শিখে ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি লাভ করতে অধিক আগ্রহী ছিল ।
সিপাহী বিদ্রোহ অবসান হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার ভারত শাসনের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনে । ভারতবর্ষের মতো একটি বিরাট দেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি বণিক প্রতিষ্ঠানের হাতে রাখা ঠিক নয় । এই কারণে ভারত শাসনের দায়িত্ব সরাসরি ব্রিটিশ সরকার নিজে হাতে নেয় এবং ভারতের গভর্নর গভর্নর জেনারেলে পরিণত হন । আঠারোশো আঠান্নো খ্রিস্টাব্দে মহারানী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রে বলা হয় ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর ধর্মে হস্তক্ষেপ করবে না এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতবাসীকে যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হবে তবে সরকারের উচ্চপদগুলি ইংরেজদের জন্য সংরক্ষিত থাকে ।
ঊনিশ শতকের শুরুতে বাংলায় ও পরে বোম্বাই ও মাদ্রাজে বেশ কিছু গোষ্ঠী গড়ে ওঠে এই কারণে ঐতিহাসিক অনিল শীল 1857 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1885 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে সভা সমিতির যুগ বলে অভিহিত করেছেন । 1836 খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ,1837 খ্রিষ্টাব্দে জমিদার সভা , 1839 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি , 1843 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দি বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, 1851 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন , 1876 খ্রিস্টাব্দে ভারতসভা , 1867 খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠিত হয় । এছাড়া শিশির কুমার ঘোষ প্রতিষ্ঠা করেন ইন্ডিয়ান লিগ । 1867 খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পুনা সার্বজনিক সভা ।
1876 খ্রিস্টাব্দে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতসভা । ভারতসভা ভারতীয়দের রাজনৈতিক সচেতন করে তোলে , ভারতবাসীর দাবিদাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরে । অস্ত্র আইন , দেশীয় ভাষায় সংবাদপত্র আইন,ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ভারতসভা আন্দোলন গড়ে তোলে । 1867 খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র ও রাজনারায়ণ বসু হিন্দু মেলা প্রতিষ্ঠা করেন । হিন্দু ঐক্য প্রতিষ্ঠা , স্বদেশী দ্রব্যসামগ্রীর প্রর্দশন , জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটানোই ছিল এই সভার লক্ষ্য ।
এই প্রশ্নগুলি প্রস্তুত করতে হবে - আঠারশো সাতান্ন খ্রিস্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহকে কি জাতীয় বিদ্রোহ বলা যায় ? সভা সমিতির যুগ বলতে কী বোঝ ? হিন্দু মেলা কারা কবে প্রতিষ্ঠা করেন ? ভারত সভা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কি ছিল ? মহারানীর ঘোষণাপত্র বলতে কী বোঝো ? ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন ?
আগামীদিন পরবর্তী ক্লাস । ছাত্র-ছাত্রী , অভিভাবক - অভিভাবিকা দের কোনও প্রশ্ন থাকলে এই হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে জানাতে হবে - 9932881330 . ক্লাসের আপডেট পেতে সার্চিং করুন ফেসবুকে ' ভারত নিউজ ' বা ' ভারত নিউজ Page ' অথবা গুগলে সার্চ করুন bharatnewspanskura.blogspot.com . ধন্যবাদ । বাড়িতে থাকুন , সুস্থ থাকুন ।
No comments:
Post a Comment